সিএইচটি টুডে ডট কম, বান্দরবান। একসময় বান্দরবানের পাহাড়ে আবাদকৃত কাজুবাদাম গাছেই নষ্ট হয়ে যেত, কাজু বাদামকে স্থানীয় বাসিন্দারা টাম নামেই ডাকতো। এই কাজু বাদাম চাষ করে অনেকে বেশিরভাগ বছরই ক্ষতির মুখে পড়লেও এখন দিন পাল্টে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা সৃষ্টির ফলে নতুন আশার আলো দেখছে কাজুবাদাম চাষীরা।
বান্দরবান সদরের ১নং ওয়ার্ডের পশ্চিম বালাঘাটায় ২০শতক জমি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে কিষান ঘর এগ্রো নামে একটি কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, যেটি তিন পার্বত্য জেলার প্রথম কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। আর এই প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা যাত্রা শুরু করার খবর পেয়ে বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলার কাজু বাদাম চাষীদের মুখে হাসি ফুটেছে।
জানা যায় বিগত বছরগুলোতে বান্দরবানে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণের কোন কারখানা না থাকায় গাছে নষ্ট হতো বেশিরভাগ কাজুবাদাম,তবে বান্দরবানে এই প্রথম কিষান ঘর এগ্রো কাজু বাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা চালুর ফলে চাষীরা স্থানীয়ভাবে কাজুবাদাম বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে আর এতে নতুন স্বপ্ন বুনছে চাষী,ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টরা।
কিষান ঘর এগ্রো কারখানায় কর্মরত সুপারভাইজার মো.ইসরারুল হক চৌধুরী জানান,আমি বিগত ৪মাস যাবৎ এই কারখানার প্রধান সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করছি এবং এই কারখানায় আমরা বান্দরবানের রুমা ,থানচি ,রোয়াংছড়ি থেকে সংগ্রহ করা কাজুবাদাম নিয়ে এসে তা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে শুকিয়ে এবং প্রক্রিয়াজাত করে ভালোমানের বাদামগুলো বিশেষ পক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে প্যাকেটজাত করে থাকি। সুপারভাইজার মো.ইসরারুল হক চৌধুরী আরো জানান,তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবানে এবং দেশের হাতেগোনা কয়েকটি কাজুবাদাম প্যাকেটজাত কারখানার মধ্যে বান্দরবানের কিষান ঘর এগ্রো অন্যতম , কেননা এই প্রতিষ্ঠানটি সৃষ্টির ফলে এখানে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে এবং তার পাশাপাশি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আমাদের এই কাজুবাদাম এখন বহিবিশ্বে রপ্তানি হচ্ছে।
কিষান ঘর এগ্রো কারখানায় কর্মরত সহকারী সুপারভাইজার মো.রকিউদ্দিন বলেন,আমরা এই কারখানায় কাজ করে বেশ ভালো আছি পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে দিনযাপন করছি। সহকারী সুপারভাইজার মো.রকিউদ্দিন আরো বলেন,করোনার এই দু:সময়ে আমাদের কোন কাজ না থাকায় দুশ্চিন্তায় মধ্যে সময় কাটাছিলাম,তবে এই কারখানায় কাজ করে বেশ ভালো বেতন পাচ্ছি এবং নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।
কিষান ঘর এগ্রো কারখানায় কর্মরত শ্রমিক ইয়াসনুর বেগম বলেন,আমরা প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করি। এখানে আমরা কাজু বাদাম প্যাকেট করার আগে চুড়ান্ত পর্যায়টি পরীক্ষা করে বাছাই করি। শ্রমিক ইয়াসনুর বেগম আরো বলেন,১কোজি গোটা কাজু বাদাম বাচাই করলে আমরা ১০০ টাকা এবং অর্ধ ভাঙ্গা ১কোজি কাজু বাদাম বাচাই করলে ৬০ টাকা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকি। প্রতি ১০দিন অন্তুর আমাদের মালিক আমাদের পারিশ্রমিক প্রদান করেন।
বান্দরবানের কাজু বাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা কিষান ঘর এগ্রো এর চেয়ারম্যান মো.তরিকুল ইসলাম জানান,বান্দরবানের কাজুবাদাম চাষীদের বাদাম স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে জেলা সদরে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করার উদ্যেশে আমরা ৪জন উদ্যোক্তা এই কিষান ঘর এগ্রো নামে কারখানাটি শুরু করেছি এবং আমরা মনে করি এই কারখানা যাত্রার মধ্য দিয়ে বান্দরবানের কাজু বাদাম চাষীরা উপকৃত হবে। কিষান ঘর এগ্রো এর চেয়ারম্যান মো.তরিকুল ইসলাম আরো জানান,২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে আমরা কাজুবাদাম প্যাকেটজাত কার্যক্রম শুরু করেছি এবং আমরা সফলতা পেয়েছি। চেয়ারম্যান মো.তরিকুল ইসলাম আরো জানান,আমার স্বপ্ন ছিল কৃষি নিয়ে কাজ করা আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে চাষীদের সাথে কাজ করে কৃষির উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
বান্দরবানের কাজু বাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা কিষান ঘর এগ্রো এর পরিচালক তোহা চৌধুরী জানান,আমাদের এই প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় বর্তমানে অর্ধশতাধিক শ্রমিক কাজ করছে সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। এখানে দক্ষ ৪জন সুপারভাইজার রয়েছে যারা এই কাজে পারদর্শী এবং ভালো মানের কাজুবাদাম প্যাকেট করতে দক্ষ। পরিচালক তোহা চৌধুরী আরো জানান,আমাদের এই কারখানায় এই পর্যন্ত প্রায় ৫৯লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং ১৫টি অত্যাধুনিক মেশিন ক্রয় করা হয়েছে যার মাধ্যমে আমরা ভালোমানের কাজুবাদাম প্যাকেট করতে সক্ষম হয়েছি।তোহা চৌধুরী আরো জানান,আমরা ইতিমধ্যে বান্দরবান জেলা ছাড়া ও চট্টগ্রাম,ঢাকা,রাজশাহী,কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় আমাদের কাজুবাদামের প্যাকেট বাজারজাত করেছি এবং দেশের চাহিদা মিটিয়ে লন্ডনে ৫০০ কেজি কাজু বাদাম রপ্তানির অর্ডার পেয়েছি যার মধ্যে আমরা প্রাথমিকভাবে ১৫কেজি পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। তোহা চৌধুরী আরো জানান,আমাদের এই কারখানায় বাছাইকৃত ও প্যাকেটজাতকৃত কাজুবাদাম দেশের অন্যান্য কারখানার চেয়ে সেরামানের।
বান্দরবান সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.ওমর ফারুক বলেন,বান্দরবানে ২০-২৫ বছর পূর্ব থেকে কাজুবাদাম চাষ হয়ে থাকলে ও আগে বান্দরবানে কাজুবাদামের তেমন চাহিদা ছিল না। বিগত কয়েকবছর ধরে বান্দরবান সদর উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় চাষীরা কাজুবাদামের বাগান বৃদ্ধি করেছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজুবাদাম হয় বান্দরবানে, এটির পুস্টিগুন ও প্রচুর। তিনি আরো বলেন,আগে দেশের উৎপাদিত কাজুবাদাম গোটা অবস্থায় বিদেশ গিয়ে সেখান থেকে প্রক্রিয়াজাত করে আবার বাংলাদেশের ফেরত এসে দেশের বাজারে বিক্রি হত,কিন্তু এখন বান্দরবানে এই প্রক্রিয়াজাত কারখানা হওয়ায় আর বিদেশ যেতে হচ্ছে না দেশেই কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করা হচ্ছে এবং বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বান্দরবান সদর উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে,বান্দরবানে ১৭৯৭ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম চাষ হচ্ছে আর জেলায় ২ হাজার ৭শত ৭৯জন কাজুবাদাম চাষী রয়েছে এর প্রেক্ষিতে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জেলায় উৎপাদন হয়েছে ১৩২৩ মেট্রিক টন কাজুবাদাম।